জীবন ও পরিবার

ওরাওঁদের ভাষা লোকসাহিত্য সমৃদ্ধ

বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন সুখবর বাংলা বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার আজ প্রকাশিত হলো ১৮তম পর্ব

নিখিল মানখিন, সুখবর বাংলা: বাংলাদেশ বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে একটি হলো ওরাওঁ। দেশের  উত্তরাঞ্চলে তাদের বসবাস। তাদের  নিজস্ব ভাষা থাকলেও বর্ণমালা নেই। সমাজে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান। ওরাওঁ জাতি সহজ, সরল ও খুব পরিশ্রমী। কৃষিকাজ তাদের প্রধান জীবিকা। ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এই জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। সনাতন ধর্মের অনুসারী হলেও তাদের অনেকে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশে তাদের জনসংখ্যা আট হাজারেরও কম।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলে ওরাওঁ জাতির বসবাস। অর্থনৈতিক ও শিক্ষার দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে তারা। তাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির পথে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় তারা তীব্র সংগ্রাম করছে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা তাদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্ব ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন সঞ্জীব দ্রং।

অবস্থান:

ওরাওঁ জাতির নেতৃবৃন্দ জানান, ওরাওঁ আদিবাসীরা নৃতাত্ত্বিক বিচারে আদি-অস্ট্রেলীয় (প্রোটো-অস্ট্রেলীয়) জনগোষ্ঠীর উত্তর পুরূষ। নৃতত্ত্ববিদগণের মতে, একই অঞ্চলের মুণ্ডা, মালপাহাডি় ও সাঁওতালদের সঙ্গে ওরাওঁদের ঘনিষ্ঠ জনতাত্ত্বিক সম্পর্ক রযে়ছে। ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক সোসাইটির মতানুসারে কুরুখ জাতি বা ওঁরাওদের আদিবাস ছিলো কঙ্কন অঞ্চলে যেখান থেকে তারা অভিবাসিত হয়ে উত্তর ভারতে চলে আসে। বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহীতে তাদের বসবাস। ঢাকার গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে কিছু সংখ্যক ওরাওঁ পরিবার বাস করে।

অর্থনেতিক অবস্থা ও জীবিকা:

গাজীপুরের শ্রীপুরের ওরাঁও সম্প্রদায়ের যুবক জগদীস জানান, আমরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থার মত এখন বসবাস করছি। শুধু দু’মুঠো ভাতের জন্যই আমাদের সংগ্রাম। এর জন্য পুরুষের পাশাপাশি প্রতিটি সংসারের নারীদেরও মাঠে কৃষিশ্রম বিক্রি করতে হয়। আর দরিদ্রতার কারণে এখানকার শিশুরা শিক্ষালাভ করতে পারে না। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতায় দিন দিন দারিদ্র্য সীমার নিচে ধাবিত হচ্ছে। এছাড়া, সংখ্যালঘু হওয়ায় স্থানীয়দের অত্যাচার ও নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছে তারা। এ কারণে ইতিমধ্যে অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। ফলে, প্রতিনিয়তই ওরাওঁদের সংখ্যা এখানে কমে যাচ্ছে।

মাঠে কৃষি কাজ করেন  সোনিয়া এক্কা। তিনি বলেন, তারা কৃষি কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ আয়ত্ত করতে পারেননি, তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই কৃষি শ্রমিকের কাজ করেন। অভাবের কারণে শিক্ষার আলো না থাকায় অন্যত্র কাজের কথা ভাবতেও পারেননি। এই সম্প্রদায়ের শিউলি লাকরার অভিযোগ, জীবিকার তাগিদে আমরা মাঠে কাজ করি, এতে অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়। তবে নারীরাও সমান কাজ করার পরও পুরুষের সমান মজুরি পান না। কৃষি কাজেও রয়েছে আমাদের মজুরি বৈষম্য।

শান্তনা কুজো বলেন,  দরিদ্রতার কারণে অনেকে শহরমুখী হয়ে পড়েছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে কাজকর্ম করে বেঁচে থাকার চেষ্টা  করছে অনেকে। সীমিত সংখ্যক হলেও শিক্ষিতরা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিসিয়াল কাজ করছে। যারা শহরে গিয়ে ভালো কাজ করছে, তাদের পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসতে শুরু করেছে বলে জানান শান্তনা কুজো।

ভাষা:

আদিবাসী নেতা সুবর্ণ এক্কা জানান, ওরাওঁদের ভাষা কুরুখ নামে পরিচিত। এ ভাষার কোনো লিখিত রূপ নেই, তবে তা লোকসাহিত্য সমৃদ্ধ। এতে অসংখ্য উপকথা, রূপকথা, গীত, ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ ইত্যাদি রয়েছে। শিক্ষিত ওরাওঁরা বাংলা অথবা ইংরেজি অক্ষরে তাদের ভাষা লিখে থাকে। এ ভাষায় বিভিন্ন ঋতু ও পার্বণ-ভিত্তিক গান আছে। লোকসাহিত্য ওরাওঁদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও হাসিকান্নার বাহক। প্রেম, প্রকৃতি, জীবিকা, আচার-অনুষ্ঠান, জন্মমৃত্যু ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত ওরাওঁ লোকসঙ্গীত যথেষ্ট কাব্যময় এবং একটি শক্তিশালী ভাষার পরিচায়ক। এ ভাষায় অগণিত ছেলেভুলানো ছড়া ও ঘুমপাড়ানি গান রয়েছে। কোনো কোনো ধাঁধা ওরাওঁ ও বাংলা ভাষায় একই রকম। কিছু কিছু ওরাওঁ উপকথা বাংলা ও অন্যান্য আদিবাসী উপকথার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ; এমনকি, চীনা উপকথার সঙ্গেও সেগুলির মিল দেখা যায়।

করম উৎসব

শিউলি লাকরা জানান, ধান রোপণের পর তারা অবিরাম অবসর লাভ করে। করম হলো সেই ভাদ্র মাসে পালিত বার্ষিক উৎসবগুলির মধ্যে একটি। করম উৎসব উদযাপনের জন্য, পুরুষ এবং মহিলারাও পূজার প্রথম দিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস করে। তারা রোজার মাধ্যমে করম পূজা শুরু করে। পরে তারা মাদল, ঢোল, করতাল এবং ঝুমকির সুরে নৃত্য করে এবং এলাকা থেকে করমগাছ (খিলকদম) এর শাখা নিয়ে আসে। তারপর তারা পূজার একটি বেদী তৈরি করে। যখন সূর্যের আলো পশ্চিমে কাত হয়ে যায়, তখন ক্যারামেল গাছের ডালগুলি পূজার বেদীতে লাগানো হয়। পুরোহিতরা উৎসবের আলোকে ধর্মীয় গল্প বলতে থাকেন। যার সাথে আসে গল্পের অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা যখন ব্যাখ্যা শেষ হলো, তখন যুবক-যুবতীরা বেদীর চারপাশে নাচতে থাকে। এদিকে, পুরোহিতের ধর্মীয় কাহিনী পড়ার পর ওরাওঁরা তাদের রোজা ভাঙে। এরপর আমন্ত্রিত অতিথি ও স্বজনদের জন্য বিভিন্ন বাড়ি থেকে ভাত ও ডাল দিয়ে একটি ভোজের আয়োজন করা হয়।

সামাজিক রীতি ও পোশাক-পরিচ্ছদ:

আদিবাসী নেতা পল্লব চাকমা জানান, ওরাওঁ জাতির পরিবার পিতৃতান্তিক। এজন্য একই পিতার সকল সন্তান পিতার গোত্রে পরিচয় লাভ করে। পিতা মিনজী গোত্রের/পদবীর হলে তার ছেলেমেয়েরা মিনজী পদবীতে পরিচয় লাভ করবে, মাতার পদবীতে নয়।  ওরাঁওদের মোট পদবী/গোত্রের সংখ্যা ৬৪টি। এসব গোত্রকে ৮টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একই গোত্রের সদস্যকে ওরাওঁরা একই বংশের সন্তান বলে মনে করে এবং তারা নিজেদের ভাই-বোন হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে তাদের একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

তারা নৃত্য ও সঙ্গীত উৎসব যাবতীয় বিবাদ মেটানো ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গ্রাম সংগঠন আছে যাকে বলা হয় পাঞ্চেস। প্রতিটি গ্রামে একজন হেডম্যান বা মহাতোষ থাকে এবং একজন পুরোহিত বা নাইগাস থাকে। গ্রামের বয়স্ক সাত-আটজন ব্যক্তি দ্বারা পাঞ্চেস গঠিত হয়। পাঞ্চেস-এর কার্যকাল সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য হয়। কোনো অভিযোগকারী যদি পাঞ্চেস-এর বিচারে সন্তুষ্ট না হয়, তবে উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে আপিল করার ব্যবস্থা রয়েছে। পাঞ্চেস-এর উপরের সংগঠনের নাম পাঁড়হা।

ওরাওঁদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ছিল অতি সংক্ষিপ্ত। পুরুষদের নেংটি আর নারীদের ফতা নামের গায়ের উপরে নীচে দুখন্ড ক্ষুদ্র বস্ত্র। এখন তাদের পুরুষেরা লুঙ্গি ও ধুতি পরে। গায়ে শার্ট ও পাঞ্জাবি পরিধান করে। ওরাওঁ নারীরা ব্লাউজ ও সায়া সহযোগে শাড়ি পরিধান করে। শিক্ষিত ওরাওঁ ছেলেরা প্যান্ট শার্ট পরে এবং মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ ও শাড়ি পরিধান করে। ওরাওঁ নারীরা বিভিন্ন অলংকার পরিধান করে। তারা নাকে পরে নাকফুল (কারমা শিকড়ি), গায়ে পায়রা, পদনখে মুদদী, চুলের খোঁপায় রূপার কাঁটা (খংশ) প্রভৃতি অলংকার।

আরো পড়ুন:

চাক জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা দশ হাজারের কম || বিয়েতে আছে নানা আচার ও রীতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *