স্বাস্থ্য

কষ্টদায়ক রোগ আর্থ্রাইটিস থেকে বাঁচতে কী পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা

নিখিল মানখিন, সুখবর ডটকম: অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়ার প্রদাহজনিত রোগের নাম আর্থ্রাইটিস। এ রোগের চিকিৎসার অগ্রগতি রোগের অবস্থা ও কারণের ওপর নির্ভর করে। শুরুতেই বা কম উপসর্গ অবস্থায় রোগ নির্ণয় করতে পারলে এর অগ্রগতি ভালো হয়। কিন্তু রোগ নির্ণয় করতে দেরি হলে অথবা শেষ ধাপে পৌঁছে গেলে রোগের অবনতি হতে থাকে। এটি নির্দিষ্ট একটি রোগ নয়। রিউমাটয়েট আর্থ্রাইটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিসসহ অনেক ধরনের রোগের সমন্বয় হলো আর্থ্রাইটিস। তাই আর্থ্রাইটিস যে কারণে হয়েছে তা নির্ণয় করে চিকিৎসা করা গেলে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি হয় অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস।

‘আর্থ্রাইটিস ফাউন্ডেশন’ আটল্যান্টা’-এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে মানুষের অক্ষমতার প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো আর্থ্রাইটিস। বাংলাদেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের বাত ও জটিল বাতরোগে আক্রান্ত। তবে এখনো অনেকে এই বিষয়ে ধারণা রাখে না। এটি অনেকগুলো রোগের প্রধান লক্ষণ। সবচেয়ে বেশি হয় অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস।

আর্থ্রাইটিস:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মিনহাজ রহিম চৌধুরী সুখবর ডটকমকে বলেন, আর্থ্রাইটিস বলতে সাধারণত অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টের প্রদাহকেই বোঝানো হয়। এটি নির্দিষ্ট একটি রোগ নয়।  তবে সবচেয়ে বেশি হয় অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস।

তিনি বলেন, রিউমাটয়েট আর্থ্রাইটিস, স্পনডাইলো আর্থ্রাইটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিসসহ ১২০টি বড় ধরনের রোগসহ প্রায় সাতশ রোগের সমন্বয় হলো আর্থ্রাইটিস। বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের আর্র্থ্রাইটিস বা বাত-ব্যথায় ভুগছেন। তাদের মধ্যে ২৪ শতাংশের কর্মক্ষমতা কম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা:

সম্প্রতি আর্থ্রাইটিস নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন ও রিউমাটোলজি বিভাগ। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ডা. মঈনুল হাসান। দেশের গ্রামাঞ্চলের বয়স্ক মানুষদের বাত-ব্যথার ব্যাপকতা জানতে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলের ৬০ বছরের বেশি বয়সী ৫২ শতাংশ মানুষ আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন। এতে পুরুষ ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ এবং নারী ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ। বাত ব্যথায় আক্রান্ত প্রবীণদের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশের কোমর ব্যথা এবং ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশের হাঁটুতে বেশি ব্যথা রয়েছে। বাত ব্যথায় আক্রান্তদের বয়স্কদের মধ্যে ৪ শতাংশের মধ্যে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস।

ডা. মঈনুল হাসান বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ কোনো না কোনো ধরনের জটিল বাতরোগে ভুগছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার জন্য শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটিমাত্র রিউমাটোলজি বিভাগ চালু আছে। রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য মাত্র ৫০ থেকে ৬০ জন রিউমাটোলজিস্ট (এমডি কোর্স সম্পন্ন চিকিৎসক) রয়েছেন।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস অস্টিও আর্থ্রাইটিস:

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অস্টিও আর্থ্রাইটিস এর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অর্থোপেডিকস ও ট্রমা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল বলেন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস একটি অটোইমিউন রোগ এবং এটা সচরাচর প্রথম জীবনে হয়। অন্যদিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিস একটি বয়স সম্পর্কিত রোগ, যা কার্টিলেজের ক্ষয় বা ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য হয়।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস সাধারণত ২৫ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে ঘটে থাকে, তবে এটা শিশুদেরও আক্রান্ত করে। অস্টিও আর্থ্রাইটিস সাধারণত ৪০ বছরের বেশি বয়সী লোকদের আক্রান্ত করে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে প্রায় সমানভাবে শরীরের দু’পাশের অর্থাৎ ডান ও বাম দিকের অস্থিসন্ধিগুলো আক্রান্ত হয়।

অন্যদিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিসে শরীরের পৃথক পৃথক অস্থিসন্ধি আক্রান্ত হয় অথবা প্রথম দিকে শরীরের শুধু এক পাশের অস্থিসন্ধিগুলো আক্রান্ত হয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত অস্থিসন্ধিগুলো লাল ও গরম হয় এবং ফুলে যায়। অন্যদিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিসে অস্থিসন্ধিগুলো সাধারণত লাল ও গরম হয় না।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস অনেক অস্থিসন্ধিকে আক্রান্ত করে, সাধারণত হাত ও পায়ের ছোট জোড়াগুলো বেশি আক্রান্ত হয়। এটা কনুই, কাঁধ, কবজি, হিপ, হাঁটু ও গোড়ালির গাঁটকেও আক্রান্ত করে। অন্যদিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিস সাধারণত শরীরের ওজন বহনকারী অস্থিসন্ধিগুলোকে এবং যেসব অস্থিসন্ধি বেশি ব্যবহৃত হয় (যেমন হাঁটু ও হিপ) সেসব অস্থিসন্ধিকে বেশি আক্রান্ত করে।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস শরীরের সব তন্ত্রকে আক্রান্ত করতে পারে। সেই সাথে সার্বিক অসুস্থতা বোধ হয় এবং অবসন্নতা দেখা দিতে পারে, শরীরের ওজন কমে যেতে পারে। অন্যদিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিসে সাধারণত আক্রান্ত জোড়াগুলোতে অস্বস্তিবোধ হয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে সকালবেলা দীর্ঘ সময় আক্রান্ত জোড়াগুলো শক্ত থাকে। অন্যদিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত জোড়াগুলো সকালবেলা অল্প সময় শক্ত থাকে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে মারাত্মক অবসন্নতা দেখা দেয়। অন্য দিকে অস্টিও আর্থ্রাইটিসে তেমন অবসন্নতা দেখা দেয় না।

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:

ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারি অধ্যাপক ডা. রফিক আহমেদ বলেন, বেদনানাশক ওষুধ সেবনই আর্থ্রাইটিস চিকিৎসার মূল কথা নয়। অনেক সময় অর্থপেডিক (হাড় ও জোড়া রোগ বিশেষজ্ঞ) সার্জন, নিউরোমেডিসিন ও নিউরোসার্জনের পরামর্শের প্রয়োজন হয়। প্রায় প্রতিটি মেডিকেল কলেজেই ফিজিওথেরাপি সেন্টার, ক্লিনিকগুলোতেও ফিজিওথেরাপি বিভাগ রয়েছে। আর্থ্রাইটিস যে কারণের জন্য হয়েছে সে কারণকে রোগ নির্ণয় পূর্বক চিকিৎসা করা হলে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। চিকিৎসার পূর্বশর্ত রোগ নির্ণয় করা, রোগ নির্ণয়ের পূর্বশর্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।

ডা. রফিক আহমেদ আরও বলেন, যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। রোগের ধরন এবং নিরাময় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন। ব্যথার ওষুধ বেশি ব্যবহার না করে জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করুন। মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকুন। অতিরিক্ত বিশ্রামের পরিবর্তে কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করুন। ব্যায়াম করাকে একটি নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করুন। অবসর সময় প্রিয়জনের সঙ্গে অতিবাহিত করুন। টেবিলে বসে ঝুঁকে পড়াশোনা করবেন না। নরম গদি-তোশক এবং উঁচু বালিশ বেশি ব্যবহার করবেন না। দেহের মেদ কমান-পুষ্টিকর খাবার খান। টেনশন কমান। প্রতিদিনই হালকা কিছু ব্যায়াম করুন। নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করুন। শীতকালে ঠাণ্ডায় এবং বর্ষায় স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় বয়স্করা সাবধানে থাকবেন। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং ওষুধ সেবন করবেন।

তিনি আরও বলেন, আক্রান্ত হলে সম্পূর্ণ বিশ্রাম-৩ থেকে ৭ দিন। মালিশ নিষেধ, এক বালিশ ব্যবহার করবেন, শক্ত ও সমান বিছানায় ঘুমাবেন।  ফোম, জাজিম ব্যবহার, সামনে ঝোঁকা, ভারি কাজ, গরম সেঁক নিষেধ। উঁচু কমোড ব্যবহার করবেন। নিচে বসা নিষেধ, সোজা হয়ে বসবেন। মগ দিয়ে পানি ঢেলে গোসল করবেন না, শাওয়ার ব্যবহার করবেন, কোমরে বেল্ট (করসেট) পরবেন, যার ঘাড়ে সমস্যা তারা কলার ব্যবহার করবেন।

 চিকিৎসা সেন্টার সীমিত, সচেতন হতে হবে:

সুচিকিৎসার পাশাপাশি আর্থ্রাইটিস সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের  উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শরফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সবাইকে সচেতন হতে হবে৷ শুরুতেই ভালো চিকিৎসা নিতে হবে৷ কারণ ব্যথার কষ্টে থাকা মানুষ কোনো কাজ করতে পারে না। ফলে এটি দেশের অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর।

বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় জোর দিচ্ছে এমনটা জানিয়ে বিএসএমএমইউ উপাচার্য বলেন, আমি জানি রিউমাটোলজি বিভাগ নানা ধরনের সংকটের মধ্যে আছে। তারপরও বিভাগটি সকল মানুষকে সচেতন করতে সবসময় কাজ করছে। আমরা এখন গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াচ্ছি। এই বিভাগের জন্য আরও বরাদ্দ বাড়ানোর ব্যবস্থা করবো। একবার আক্রান্ত হলে আর্থ্রাইটিস থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া কঠিন বলে জানান ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রিউমাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউমাটোলজি বিভাগ এখন পর্যন্ত ৬০ জন বিশেষজ্ঞ রিউমাটোলজিস্ট তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। আরও ৩০ জন রিউমাটোলজিস্ট এই বিষয়ে দেশে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। তবে বাত রোগীদের দোরগোড়ায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবা পৌঁছানো সময়ের দাবি। এজন্য পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ সমভাবে যেমন দরকার, তেমনি পাস করা রিউমাটোলজিস্টদের যথাযথ পদায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *