যানজট বাড়ার জন্য দায়ী ছোট গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি
নিজস্ব প্রতিবেদক, সুখবর বাংলা: রাজধানীতে গত কিছুদিন ধরে যানজট বেড়ে যাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত গাড়ির এমন বেড়ে যাওয়াকে কারণ দেখাচ্ছে সড়কে শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা।
এদিকে দেশে মানুষের আয় বাড়ার কারণে সড়কে গাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে বলে সংসদে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহনে জোর না দিয়ে ছোট গাড়িকে উৎসাহ দেওয়া সড়কে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
মহামারীর বিধি-নিষেধ পেরিয়ে গত মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত পুরোপুরি চালু হওয়ার পর যানজটে নাভিঃশ্বাস উঠছে রাজধানীবাসীর।
রোজা শুরুর পর চৈত্রের গরমের মধ্যে যানজট আরও অসহনীয় হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থেকে ইফতারও পথেই করতে হচ্ছে অনেককে।
নগর ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা দরকার হলেও ঢাকায় আছে নয় শতাংশের মতো। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে গণপরিবহন বাড়ানোর পরামর্শ বিভিন্ন সময় দেওয়া হলেও তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। ফলে যানজট নিরসনে নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও ব্যক্তিগত ছোট ছোট গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলছে। ফলে এসব প্রকল্প যানজট নিয়ন্ত্রণে তেমন কাজে আসছে না।
৮৩৭৪ বনাম ৩৬২
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় গত তিন মাসে নিবন্ধিত হয়েছে ৪৩ হাজার ৬২১টি যানবাহন।
এর মধ্যে ব্যক্তিগত ও ছোট গাড়ি ৮ হাজার ৩৭৪টি। বাস ও মিনিবাস ৩৬২টি। আর সবচেয়ে বেশি নিবন্ধিত হয়েছে মোটর সাইকেল, সংখ্যাটি ২৯ হাজার ১০৮।
যানবাহনের এই সংখ্যা বিআরটিএর ঢাকার তিনটি মেট্রো সার্কেল থেকে সংগ্রহ করা। এরমধ্যে ঢাকা মেট্রো সার্কেল-১ (মিরপুর) এবং ঢাকা মেট্রো সার্কেল-২ (ইকুরিয়া) থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এবং ঢাকা মেট্রো সার্কেল-৩ (উত্তরা) থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত হালগানাদ তথ্য পাওয়া গেছে। ৩১ মার্চের তথ্য যোগ করলে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা কিছুটা বাড়বে।
বিআরটিএর হিসাবে, চলতি বছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে সারাদেশে ৯৬ হাজার ৮৭৮টি যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছে। এ সময় ঢাকায় নিবন্ধিত হয় ২৯ হাজার ৬৭৮টি যানবাহন, যা মোট সংখ্যার ৩০ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
২০২১ সালে ঢাকায় ১ লাখ ৫০ হাজার ৫৬১টি, ২০২০ সালে ১ লাখ ১৮ হাজার ২৫৪টি যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছিল।
সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ঢাকায় ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৭৫টি যানবাহন নিবন্ধিত।
বিআরটিএর তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধিত মোটর যানের সংখ্যা ৫১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬টি। এর মধ্যে প্রাইভেটকার ৩ লাখ ৮৫ হাজার। বাস ৪৯ হাজার ৬৭৩টি। মোটর সাইকেলের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার।
মন্ত্রী তাজুল বুধবার সংসদে যানজটের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যোগসূত্র দেখান।
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। তাই সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে। কারণ আমাদের আয় অনেক বাড়ছে। ৩০০ থেকে ৪০০ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশ থেকে ২ হাজার ৫৯১ ডলার মাথাপিছু ডলারের দেশ। এখন সবাই গাড়ি কিনছেন।”
‘১টার জায়গায় ১০টা হলে জট থাকবেই’
যানজটের কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন পুলিশ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর ১৫ মার্চ থেকে যানজট বেড়েছে। সড়কে কিছু অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ ঢাকায় যানজট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ঢাকায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশু শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত গাড়িতে যাওয়া-আসা করে। সেক্ষেত্রে একজনের জন্য বের হয় একটি গাড়ি।
মুনিবুর বলেন, “একটা গাড়ির জায়গায় যদি ১০টা গাড়ি থাকে, তাহলে যানজট হবে, এটাই স্বাভাবিক। গাড়ি বেশি থাকলে ইন্টারসেকশনে গাড়ির সংখ্যা বাড়বে। এগুলো ম্যানেজ করা তত কঠিন হয়ে যাবে।”
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক, পূরকৌশলের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ছোট যানবাহন বাড়ছে, উল্টো কমছে বাসের সংখ্যা। এজন্য শহরে যানজট বাড়ছে।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. সালেহ উদ্দিনও বলেন, “ছোট গাড়ি অবশ্যই যানজট তৈরিতে বড় ভূমিকা পালন করছে।”
রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) জরিপ অনুযায়ী, রাজউক এলাকায় সড়ক রয়েছে ১৩ হাজার ৮৬৫ কিলোমিটার। পাঁচ ফুট বা তার কম প্রস্থের সড়ক ১ হাজার ৭৮৭ কিলোমিটার, ৮ ফুট বা তার কম প্রস্থের রাস্তার দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ২২ কিলোমিটার, ১০ ফুট বা তার কম প্রস্থের সড়ক ৮ হাজার ২৫৮ কিলোমিটার। ২০ ফুট বা তার চেয়ে বেশি প্রস্থের সড়ক রয়েছে ১ হাজার ৪৫৬ কিলোমিটার।
সব মিলিয়ে রাজউক এলাকায় ১০ দশমিক ৫১ শতাংশ সড়ক রয়েছে, যেখানে আদর্শ মান ২৫ শতাংশ।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার মোট সড়ক ২ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের বেশি। ডিএনসিসি এলাকায় ১৫০০ কিলোমিটার এবং ডিএসসিসি এলাকায় ১ হাজার ২২৭ কিলোমিটার।
ঢাকা মহানগরীতে যানজটে প্রতিদিন ৩৮ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়ে বলে ২০১৭ সালে বিশ্ব ব্যাংক হিসাব দেখিয়েছিল; এক বছর পর বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়, এই অঙ্কটি ৫০ লাখ কর্ম ঘণ্টা।
এই যানজটে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ হাজার কোটি টাকা বলে তিন বছর আগে দেখিয়েছিল বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, যা জাতীয় বাজেটের ১১ ভাগের এক ভাগ।
গণপরিবহনে গুরুত্ব নেই
বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা বারবার গণপরিবহনে জোর দিতে বললেও তা উপেক্ষা করে আসছে সরকার। ফলে যানজট পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, সরকার বিভিন্ন সময় ছোট যানবাহন নিরুৎসাহিত করার কথা বলছে। কিন্তু পাশাপাশি সহজ শর্তে ঋণ দেওয়াসহ নানা সুবিধা দেওয়ায় ব্যক্তিগত গাড়ি কিনছেন অনেকে। মোটরসাইকেল কেনার ক্ষেত্রেও নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
“কিতাবে লেখা আছে ছোট গাড়িকে নিরুৎসাহিত করা, কিন্তু কার কেনার জন্য সচিব থেকে উপসচিব, ব্যাংকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সফট লোন পায়। মোটর সাইকেলের নিবন্ধন খরচ কমানো হয়েছে, ঋণেও কেনা যাচ্ছে।”
“বসবাসযোগ্য নগরীর তালিকায় তলানীতে আসার পরও ছোট ছোট গাড়ি কিনতে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনা দেওয়া হয়-এটা উল্টো পথে চলা হচ্ছে,” বলেন তিনি।
এই অধ্যাপক বলেন, “যানজটের যত রেসিপি আছে সবগুলোই তৈরি হয়েছে। সে হিসাবে আমার মনে হয়, পরিকল্পিতভাবে, সমন্বিতভাবে কাজ না করে টাকা খরচের কাজগুলো আমরা করে যাচ্ছি। অনেকগুলো প্রজেক্ট বাস্তবায়নের পরও যেহেতু যানজট কমছে না, তাতে বোঝা যায়, দাওয়াই খুব একটা কাজ করে নাই।”
ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা মুনিবুর বলেন, “আমরা বিভিন্ন সময় বলেছি, গণপরিবহন বাড়াতে হবে, গণপরিবহনের মানও বাড়াতে হবে। তাহলে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করছে এমন মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করবে।”
ঢাকায় পর্যাপ্ত, আরামদায়ক গণপরিবহনের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে বাধ্য হয়েই গাড়ি কিনছে বলে মনে করেন ডিটিসিএর সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. সালেহ উদ্দিন।
তিনি বলেন, “ছোট গাড়ি মানুষ তখনই চালাবে, যখন আপনি তাদের উপযোগী গণপরিবহনের ব্যবস্থা না করবেন।
“এখন আমরা চাইলেই মেট্রো চালু করতে পারব না। যেটা আগে করা যায়, নগর পরিবহন সেবায় বাস বাড়ানো যায়। পাশাপাশি ফুটপাতগুলোকে দখলমুক্ত রাখতে হবে। এজন্যও যানজট তৈরি হচ্ছে।”
ঢাকায় নেমেছে নগর পরিবহনের বাস, যা যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঢাকার অসহনীয় যানজট নিরসনে সম্প্রতি নিজের হাতে দায়িত্ব চেয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
যানজট নিরসনের দায়িত্ব এখন হাতে না থাকলেও তা নিয়ে কাজ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার রাস্তায় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি রয়েছে। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে এর বিকল্প কী হতে পারে তা নিয়ে কাজ করছে সিটি করপোরেশন।
রাজধানীর বাস রুট র্যাশনালাইজেশনে যে কমিটি রয়েছে, তার মূল দায়িত্বে ঢাকার দুই মেয়র রয়েছেন। সম্প্রতি চালু হওয়া ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক ঢাকা নগর পরিবহনও চালু হয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে।
মেয়র আতিক বলেন, ছোট গাড়ির সংখ্যা কমাতে হলে দ্রুত নগর পরিবহনের বাস বাড়াতে হবে।
“নগর পরিবহনটাকে আমরা যত দ্রুত আরও কার্যকর করতে পারি, তত দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে। আমরা যখন মানুষের জন্য নগর পরিবহনকে একটা বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম হিসেবে তুলে দিতে পারব, তখন বলতে পারব যে আপনি বাসে যান, নিরাপদ। তখন মানুষ ব্যক্তিগত গাড়িতে কম উঠবে।”
আরো পড়ুন:
রিকশা ভাড়া বেশি চাইলে জরিমানা, যাত্রী দুইজনের বেশি নয়