শনিবার, ১৩ই ডিসেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কবরের জমিতে মাদক কারবার

কবরের জমিতে মাদক কারবার

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১১:৫০ পূর্বাহ্ন, ১৩ই ডিসেম্বর ২০২৫

#

কবরের জমিতে মাদক কারবার

কখনো কি চিন্তা করেছেন একই পরিবারের ৭-৮ মিলে করতে পারে মাদক ব্যবসা এবং তাদের আস্তানা কোথায়।চলুন জেনে নেয়া যাক।মনিকা, সেলিনা, মুক্তা, হিরা, মানিক—এঁরা সবাই সম্পর্কে ভাই-বোন। বাহার উদ্দিন রকি ওরফে রনি, সালাউদ্দিন, হযরত আলী ও ইব্রাহিম হলেন মনিকা, মুক্তা, হিরা আর সেলিনাদের স্বামী। এঁদের মধ্যে কেউ ভ্যানচালক, কেউ দিনমজুর হিসেবে চট্টগ্রামে এসে কয়েক শ টাকা ভাড়ায় বস্তিতে বসবাস করতেন। এঁদের সবার নাম এখন পুলিশের খাতায় মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে।

মাদক সম্পৃক্ততায় তাঁরা সবাই গ্রেপ্তার হয়েছিল অনেক আগে কারাভোগও করেছেন। মাদকের অসৎ টাকায় গড়ে তুলেছে চট্টগ্রাম শহরে দালান তুলে ভাড়া দিয়ে তাঁরা করছেন জমিদারি! কিন্তু সেই জমি তাঁদের নয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক)। চসিকের মসজিদ কমপ্লেক্স, বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও কেন্দ্রীয় কবরস্থানের জায়গায় ঘর তুলে ভাড়া দেওয়ার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন নিরাপদ মাদকসাম্রাজ্য। মাদক ব্যবসা নিরাপদ রাখতে নিয়েছেন নানা পদক্ষেপ।আরেফিননগরে চসিকের তিনটি ভাগাড় আছে। দুটি আয়তনে বিশাল এবং আরেকটি বায়োগ্যাস প্লান্টসংলগ্ন। বড় দুই ভাগাড়ে প্রবেশের মুখে চসিকের জায়গায় মনিকাদের দোকান।

সেই দোকান থেকে ঘরের পণ্যসামগ্রী কিংবা পানপাতার মতোই কেনাবেচা হচ্ছে গাঁজা। মনিকার দোকান থেকে গাঁজা কিংবা ইয়াবা কিনে সেবন করতে যায় কেন্দ্রীয় কবরস্থান ও বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। মনিকাদের সেই দোকান থেকে শুরু করে প্রায় সব কটি দোকানেই মাদক কেনাবেচা হয় বলে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ। ঘরে ঘরে রাখা হয় মাদক। ক্রেতা গেলে টাকার পরিমাণ অনুযায়ী মাদক তুলে দেওয়া হয় হাতে।

২০০৬ সালে চট্টগ্রাম নগরের কালুরঘাট এলাকায় কেটিএস পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৬৫ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। তখন সিটি করপোরেশন অজ্ঞাতপরিচয় শ্রমিকদের জন্য গণকবরের ব্যবস্থা করে সেটিকে চসিক কেন্দ্রীয় কবরস্থান ঘোষণা দেয়। কেন্দ্রীয় কবরস্থানের পাশে বুদ্ধিজীবী কবরস্থান এলাকা ঘোষণা দিয়ে নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চসিক। চারপাশে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ ও মাটি ভরাট করে বৃক্ষরোপণ ও ফুলের বাগান করে দৃষ্টিনন্দন রূপ দেওয়া হয় এলাকাটিকে। গড়ে তোলা হয় একটি মসজিদও।

সবুজে ঘেরা সেই আরেফিননগরে চসিক যখন ভাগাড় গড়ে তোলে তখন ময়লার দুর্গন্ধে অনেকেই এলাকা ছাড়ে। এতে বিপদে পড়ে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় বাপ-দাদার ভিটিতে পড়ে আছে। কিন্তু মাদকের ভয়াল থাবা তাদের পরবর্তী বংশধরদের তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তিন ডজনের বেশি সিসি ক্যামেরায় তদারকি করা হয় পুলিশের অভিযান কিংবা গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ করার বিষয়টি। তাদের সন্দেহ হলে যে কাউকে তারা জেরা করে নাজেহাল করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেলে ড্রামে ভরে কবরের ভেতরে লুকিয়ে রাখে মাদক। সর্বশেষ অভিযানে মনিকা গ্রেপ্তার হলে তাঁর দেওয়া তথ্যে পুরনো কবর থেকে ড্রাম ভর্তি ইয়াবা ও গাঁজা উদ্ধার করে পুলিশ।

এই এলাকায় মাদকের বিস্তারের পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে একদল কিশোর গ্যাং, যারা মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়িয়ে এলাকায় ভয়ভীতি ছড়ায় এবং কেউ প্রতিবাদ করলে হামলা চালায়।

কিশোর গ্যাং ও মাদক ব্যবসা সম্পর্কে সিএমপির জিরো টলারেন্স জানিয়ে উপকমিশনার আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সেখানে বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়ে মনিকা গংয়ের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আবার যদি মাথা চাড়া দেয় আবারও অভিযান চালানো হবে।’

চসিকের ভূ-সম্পত্তি দেখাশোনা করেন মেয়রের একান্ত সচিব মো. জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘জায়গা দখলের বিষয়টি সম্পর্কে খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চসিকের উপপ্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা প্রণব কুমার শর্ম্মা বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতা বিভাগে হরিজন শ্রেণির মানুষ কাজ করে। তাদের জন্য কিছু শিথিলতা আছে। তবে সেটা কাজের সময় নয়।’

চসিকের জায়গা নিজেদের কেনা দাবি করে মাদকচক্রের অন্যতম প্রধান মুক্তা বেগম বলেন, ‘এটা সিটি করপোরেশনের বলা হতো। কিন্তু আমরা জসিম সাহেবের কাছ থেকে ক্রয় করেছি।’ সেই জসিমের নাম্বার চাইলে মুক্তা বলেন, ‘জসিম সাহেবের হার্টে রিং লাগানো হয়েছে। উনি কথা বলতে পারবেন না।’ মাদক মামলায় আটক হয়ে তাঁর পরিবারের ছয়জন কারাগারে থাকার বিষয়টি স্বীকার করে মুক্তা বলেন, ‘আমার স্বামী হযরত আলী, তার মা, আমার মেয়ে, মেয়ের জামাই, বোন সেলিনা এবং তার ছেলে কারাগারে আছে।’

চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাসযোগ্য নিরাপদ নগর গঠনে মাদক ও কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেব। চসিকের জায়গায় কোনো অবৈধ স্থাপনা থাকতে পারে না।’

কবরের জমিতে মাদক কারবার